হামদ ও দুরুদ বাদে-
আমি আপনাদের সামনে সূরায়ে কাফের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করেছি। সে আয়াতগুলোকে সামনে রেখে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলব ইনশাআল্লাহ। কথাগুলো দ্বারা আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং মজলিসে উপস্থিত সবাইকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক যেন দান করেন। আমীন।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
ﻭَ ﺍُﺯْﻟِﻔَﺖِ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔُ ﻟِﻠْﻤُﺘَّﻘِﯿْﻦَ ﻏَﯿْﺮَ ﺑَﻌِﯿْﺪ ﻫٰﺬَﺍ ﻣَﺎ ﺗُﻮْﻋَﺪُﻭْﻥَ ﻟِﻜُﻞِّ ﺍَﻭَّﺍﺏٍ ﺣَﻔِﯿْﻆٍ
জান্নাতকে উপস্থিত করা হবে মুত্তাকীদের অদূরে। তোমাদের প্রত্যেক তওবাকারী ও সংরক্ষণকারীকে এরই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। -সূরা ক্বাফ
হাশরের ময়দানে একটি দৃশ্যের কথা এই আয়াতগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতকে অদূরে এনে উপস্থিত করা হবে।
হাশরের ময়দান থেকে জান্নাত দেখা যাবে। ইশারা করে বলা হবে : ﻫٰﺬَﺍ ﻣَﺎ ﺗُﻮْﻋَﺪُﻭْﻥَ (এই জান্নাতেরই ওয়াদা করা হয়েছিল তোমাদের সাথে দুনিয়ায়।)
দুনিয়াতে জান্নাতের ওয়াদা শুনেছি না আমরা? তখন ওখানে দেখিয়ে বলা হবে- এই জান্নাতেরই ওয়াদা করা হয়েছিল তোমাদের সাথে।
কে পাবে এই জান্নাত? ﻟِﻜُﻞِّ ﺍَﻭَّﺍﺏٍ ﺣَﻔِﯿْﻆٍ ।
ﺣَﻔِﯿْﻆٍ
: যে নিজের সত্তাকে কলুষমুক্ত রাখে। নিজেকে শুদ্ধ ও সাফ-সুথরা রাখে। আল্লাহ তো আমাকে সাফ পয়দা করেছেন। জন্মের সময় গুনাহের ময়লা আমার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমি আমাকে গুনাহের ময়লা থেকে, পাপের ময়লা থেকে,
অপরাধের ময়লা থেকে সাফ-শুদ্ধ রাখব।
ﺣَﻔِﯿْﻆ-এর আরেক মর্ম
সংরক্ষিত। নিজেকে সংরক্ষণ করব সকল অপরাধ থেকে। ﺣَﻔِﯿْﻆٍ : সংরক্ষণ করব আমি আল্লাহর বিধানগুলোকে,
আল্লাহর পক্ষ থেকে বেধে দেওয়া হারাম-হালালের গণ্ডিকে। সংরক্ষণ করব আল্লাহর আহকামগুলোকে । ﺣَﻔِﯿْﻆٍ : আমি ভাল
থাকব। নিরাপদ থাকব।
এরপরও আমরা মানুষ। গুনাহ হয়ে যেতে পারে। ভুল হয়ে যেতে পারে। হয়ে গেলে আবার গুনাহর উপর অনমনীয় থাকব না। আমাদের গুনাহর উপর দম ধরে থাকব না। এমন মনে করব না যে (নাউযুবিল্লাহ) গুনাহ-ই আমার জীবনের মিশন বরং গুনাহ হয়ে গেলেই সাথে সাথে আল্লাহর দিকে ঘুরে আসব। তওবার মাধ্যমে ফিরে আসব। গুনাহ করার মানেই হল আল্লাহর কাছ থেকে আমার চেহারা ফিরে গেল। আমি তো ঈমানের মাধ্যমে, কালিমার মাধ্যমে, তাওহীদের মাধ্যমে আল্লাহমুখি ছিলাম।
ﻭﺟﻬﺖ ﻭﺟﻬﻲ ﻟﻠﺬﻱ ﻓﻄﺮ ﺍﻟﺴﻤﺎﻭﺍﺕ ﻭﺍﻷﺭﺽ .
(আমি আমার চেহারা ওই সত্তার দিকে ঘুরিয়েছি, যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও যমীন) আমি তো আল্লাহমুখি। মুওয়াহহিদ হওয়া আর কালিমা পড়ার অর্থ আমি আল্লাহমুখি। আমার দিল আল্লাহর দিকে, আমার চেহারা আল্লাহর দিকে। পক্ষান্তরে অপরাধ হওযা- গুনাহ হওয়া মানেই হল, আমি অন্যদিকে ফিরে গেলাম। আমার কেবলা পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন তো শয়তানকে আমি আমার লক্ষ্য বানিয়ে ফেললাম। নাউযুবিল্লাহ।
তওবার মাধ্যমে তাই ফিরে আসা হয়। তওবাকে তওবা এজন্যই বলা হয় যে, তওবার মাধ্যমে আবার ফিরে এসেছে। আমি তো অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। না, আমার রাস্তা তো এটা নয়। আমার গন্তব্য তো এদিকে নয়। আমার কেবলা ভিন্ন। আবার ফিরে এসেছি। আবার তওবার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছি। তওবার মানেই হল ফিরে আসা।
গুনাহর রাস্তাটা আল্লাহর রাস্তা নয়। গুনাহ করার অর্থ হল, আল্লাহর দিক থেকে আমি অন্য দিকে চলে যাচ্ছি। তওবা করে আবার আল্লাহর দিকে ঘুরছি। আমরা বেশি বেশি আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে।এক গুনাহর জন্য একশ’বার তওবা করতে হবে। গুনাহর জন্য একশবার ইস্তেগফার পড়তে হবে।
ﺃﺳْﺘَﻐْﻔِﺮُ ﺍﻟﻠﻪَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻻَ ﺇﻟَﻪَ ﺇﻻَّ ﻫُﻮَ ﺍﻟﺤَﻲُّ ﺍﻟﻘَﻴُّﻮﻡُ ﻭَﺃﺗُﻮﺏُ ﺇﻟَﻴﻪِ ، ﺭَﺏِّ ﺍﻏْﻔِﺮْ ﻟِﻲ ﻭَﺗُﺐْ ﻋَﻠَﻲَّ، ﺇِﻧَّﻚَ ﺃَﻧْﺖَ ﺍﻟﺘَّﻮَّﺍﺏُ ﺍﻟْﻐَﻔُﻮﺭُ .
সকালে এবং সন্ধ্যায় পড়ব :
ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺃَﻧْﺖَ ﺭَﺑِّﻲ ﻟَﺎ ﺇِﻟَﻪَ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﺧَﻠَﻘْﺘَﻨِﻲ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﻋَﺒْﺪُﻙَ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﻋَﻬْﺪِﻙَ ﻭَﻭَﻋْﺪِﻙَ ﻣَﺎ ﺍﺳْﺘَﻄَﻌْﺖُ ﺃَﻋُﻮﺫُ ﺑِﻚَ ﻣِﻦْ ﺷَﺮِّ ﻣَﺎ ﺻَﻨَﻌْﺖُ ﺃَﺑُﻮﺀُ ﻟَﻚَ ﺑِﻨِﻌْﻤَﺘِﻚَ ﻋَﻠَﻲَّ ﻭَﺃَﺑُﻮﺀُ ﻟَﻚَ ﺑِﺬَﻧْﺒِﻲ ﻓَﺎﻏْﻔِﺮْ ﻟِﻲ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻟَﺎ ﻳَﻐْﻔِﺮُ ﺍﻟﺬُّﻧُﻮﺏَ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻧْﺖَ .
এটি সাইয়েদুল ইস্তিগফার।
ﻟِﻜُﻞِّ ﺍَﻭَّﺍﺏٍ ﺣَﻔِﯿْﻆٍ : এখানে এই দুটি গুণের কথা বলা হয়েছে। এ গুণ দুটি কিন্তু দেখা যাবে আমার সীরাত-সুরতে। আমি ‘হাফীয কি না এবং ‘আওয়াব’
অর্থাৎ গুনাহ হয়ে গেলে ফিরে আসছি কি না।
এ দুটি গুণ মুমিনের দৃশ্য বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য। এ দুটি কখন হবে, যখন আরো দুটি অদৃশ্য বৈশিষ্ট্য মুমিনের মধ্যে থাকবে তখন। ওই দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা সামনে বলা হচ্ছে। ﻣَﻦْ ﺧَﺸِﯽَ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤٰﻦَ ﺑِﺎﻟْﻐَﯿْﺐ
ِ
(রহমানকে যে না দেখেই ভয় করে) দেখেনি সে রহমানকে এখনো,
কিন্তু সে রহমানকে ভয় করে। আসমায়ে হুসনা অনেকগুলো। আল্লাহর সুন্দর নাম অনেক। এখানে
ﺟﺒﺎﺭ (প্রতাপশালী) ﻗﻬﺎﺭ (পরাক্রমশালী) এগুলো বলা হয়নি। বলা হয়েছে, রহমান। মনে হতে পারে- ‘জাব্বারকে কাহহারকে ভয় করে’ এভাবে বলা হলে বেশি মুনাসিব হত। কিন্তু আল্লাহ এভাবেই বলেছেন এবং বাস্তবেই ভয় তো রহমানকেই করা উচিত। আমি ইনসান। যিনি আমার সাথে দয়ার মুআমালা করেন, তাকেই তো আমার ভয় করা উচিত। এখানে ভয় মানে কী? ভয় মানে মহব্বত মিশ্রিত ভয়। মানুষের জন্য আমরা
‘শ্রদ্ধা’ শব্দ যেখানে ব্যবহার করি,
মহান খালেকের জন্য সেখানে উপযোগী শব্দ যা হবে- এই ভয় দ্বারা সেটাই উদ্দেশ্য।
ﻭَ ﺟَﺂﺀﺑِﻘَﻠْﺐٍ ﻣُّﻨِﯿْﺐِ : (আল্লাহর দরবারে হাযির হয়েছে কলবে মুনিব -আল্লাহমুখি দিল নিয়ে) কলব যদি আল্লাহমুখি হয়, কলবের মধ্যে যদি রহমানের ভয় থাকে তাহলে আমলগুলোর মধ্যে দেখা যাবে ﺣَﻔِﯿْﻆٍ (সংরক্ষণকারী, কলুষমুক্ত)-এর গুণটা প্রকাশ পাবে। আচার-আচরণ,
লেনদেন, উঠাবসা যাবতীয় বিষয়ে এবং জীবনের যত অঙ্গন আছে সবগুলোর মধ্যে। আর বিপরীত কিছু হয়ে গেলেই তওবা-ইস্তেগফার করবে।
এই চারটি গুণের সমষ্টি- ব্যক্তিত্বই হল মুত্তাকী।
মুত্তাকী কাকে বলে?
মুত্তাকী হতে হলে এই চারটা গুণ লাগবে।
১| দিলে আল্লাহর খাশিয়াত (ভয়) থাকা।
২| ওটার প্রভাবে গোণাহ থেকে হাফীয হওয়া। আল্লাহর বিধানকে খেয়াল করে চলা। বেদআত থেকে বেঁচে সুন্নাত মোতাবেক চলা।
৩| গুনাহ হলে তওবা করা।
৪| আল্লাহর দরবারে আল্লাহমুখি দিল নিয়ে হাযির হওয়া। এই চারটা বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে মুত্তাকী বলা হবে।
আর ঐ মুত্তাকী মুসলমানদেরকেই বলা হবে অদূরে বেহেশতের উপস্থিতির কথা। সেখানে নিশ্চিন্তে প্রবেশ করতে বলা হবে তাদেরকে। সেখান থেকে কেউ তাদের বের করবে না।বলা হবে-
ﺍﺩْﺧُﻠُﻮْﻫَﺎ ﺑِﺴَﻠٰﻢٍ ؕ ﺫٰﻟِﻚَ ﯾَﻮْﻡُ ﺍﻟْﺨُﻠُﻮْﺩِ
তোমরা সেখানে শান্তিতে প্রবেশ কর এবং এটিই চিরকালের আবাসস্থলে প্রবেশের দিন। -সূরা ক্বাফ
জান্নাতে যারা যাবে চিরকাল থাকবে। সেখান থেকে কেউ তাদের বের করবে না।
ﻟَﻬُﻢْ ﻣَّﺎ ﯾَﺸَﺂﺀُﻭْﻥَ ﻓِﯿْﻬَﺎ ﻭَ ﻟَﺪَﯾْﻨَﺎ ﻣَﺰِﯾْﺪٌ
জান্নাতে যা তাদের মনে চায় সব পাবে এবং আল্লাহর কাছে আছে আরো বেশি।-সূরা ক্বাফ
মানুষের মনের চাওয়াও এক সময় শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর নিআমতের শেষ নেই। একথাই বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে আরো বেশি থাকবে’। তাকওয়ার এই সিফাতগুলো অবলম্বন করে আল্লাহ তাআলা আমাদের পূর্ণ মুত্তাকী হওয়ার তাওফীক দান করুন।আমীন।
ﻭﺍﺧﺮ ﺩﻋﻮﺍﻥ ﺍﻥ ﺍﻟﺤﻤﺪ ﻟﻠﻪ ﺭﺏ ﺍﻟﻌﺎﻟﻤﻴﻦ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন